আজ ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সুলেখা আক্তার শান্তা’র ছোটগল্প “অদৃশ্য দেয়াল”

অদৃশ্য দেয়াল-সুলেখা আক্তার শান্তা

———————————

আমি সব সময় বলি আমাকে এত ভালো ভালো খাবার দিবা না। কে শুনে কার কথা। দিয়েছো প্লেট ভর্তি মাছ, মাংস এত
খাওয়া যায়? বাটি দাও। হাত ধুয়ে নিজের প্লেট থেকে মাংস মাছ রেখে দেয় বাটিতে। দুলাল মিয়া খাওয়া শুরু করে। খুশি
হয়ে বলে, তোমার মাছ, মাংস রান্না বড়ই স্বাদ হয়েছে। শীতের দিন উঠানে মাদুর পেতে খেতে বসে দুলাল মিয়া। পরম
শান্তি নিয়ে খায়। সালেহা স্বামীর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, কি বলছো এসব! মাছ, মাংস পাইলা কই? তোমার
প্লেটে দিলাম শাক, পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচ। আর তুমি বলো কি!
নিয়ত গুনে বরকত। তুমি ভাববে যা তাই হবে। আমি প্রতিদিন খেতে বসে প্লেটে মাছ, মাংসই দেখি। ছেলেকে বলে, আয়
বাবা তোকে আমি খাইয়ে দেই। ছেলের মুখ হাঁ করে দুলাল মিয়া ছেলের মুখে ভাত তুলে দিয়ে বলে, খাও বাবা। বড় স্বাদ
লাগেনা খাবার?
ছেলে টুটুল মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। বাবা ভালো করে চিবিয়ে চিবিয়ে খাও।
টুটুল বলে, হ্যাঁ বাবা মাংস ভাত খেতে তো অনেক স্বাদ। সালেহা স্বামী, ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে, হইল কি বাপ, ছেলের।
দুলাল মিয়া সালেহাকে বলে, তুমিও হাঁ করো আমি তোমাকে খাওয়াইয়া দেই। সালেহা  ঝামটা মেরে উঠে, খায় শাক ভাত,
বলে, খাচ্ছে মাংস ভাত। মাশকারার আর সীমা নাই। দুলাল খাওয়া শেষে গামছায় মুখ মুছে বলে, এদিকে আসো। ভারী
কন্ঠে সালেহা স্বামীকে বলে কি ডাকো কেন? প্রতিদিন মাংস, ভাত খাও, তুমিতো জমিদার। না হলে এরকম দামি খাবার
নিত্যদিন খাওয়া যায়! দুলাল বলে, চাইলে খাওয়া যায় বউ। তাহলে একজন কাজের মানুষও তো রাখতে পারো। তোমার
এইসব রান্না করতে একজন মানুষও তো লাগে। জমিদারের বউ আমার কি কাজ কাম করা সাজে!
তুমি কি আমার সাথে মশকরা করো?
মশকরা করব কেন? খাইছো এখন কামে যাও। ছেলেকে তাড়া দেয়, টুটুল বাবা তুমি রেডি হও স্কুলে যাবা। দুলাল মিয়া
সাইকেল বের করে ছেলেকে ডাকে, আয় বাবা তোকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আমি দোকানে যাব। স্কুল থেকে আসার সময়
টুটুল কখনো একা আসে কখনো বাবার সঙ্গে আসে। দুলাল মিয়ার দোকানে অনেক সময় কাস্টমারের ভিড় থাকলে ছেলেকে
স্কুল থেকে নিয়ে আসতে পারে না তখন টুটুলকে একা আসতে হয়।
দুলাল মিয়ার বাড়িতে আগমনের সংবাদ জানান দেয় সাইকেলের টুংটাং শব্দ। সালেহা স্বামীকে ভাত বেড়ে দিয়ে বলে,
তোমার দোকান চলে বেশ ভালো, ঘনঘন মাল উঠাও। যা বেচাকেনা হয় সেই টাকা করো কি তুমি?
বউ হিসাব চাও?


তুমি আমার স্বামী তোমার কাছে আমি হিসাব চাইতে পারিনা? তুমি বাড়ি আসলেই ছেলেটা তোমাকে জড়িয়ে ধরে। হাতে
করে ছেলেটার জন্য তো কিছু নিয়ে আসতে পারো। তা তো কোন সময় কিছু নিয়ে আসো না। আর আমি কি বুড়া হয়ে
গেছি, আমার কি কিছু খাইতে লইতে মন চায় না। হাউস করতে মন চায় না।
দুলাল মিয়া মুখটা কালো করে বলে, হ্যাঁ চাইব না কেন, হাউস রং করতে মন চাইতে পারে। সকালে দুলাল মিয়া মাল
আনতে গঞ্জে যাবে। ছেলেকে বলে, বাবা তুমি স্কুলে যেও। আমার গঞ্জে দুই দিন থাকা লাগবে।
সবার যাইয়া মাল নিয়া দিনে দিনে ফিরে আসে আর তোমার থাকন লাগে!
কিনলেই তো হয়না, মাল দরদাম কইরা পছন্দ মতো কিনতে হয়।
আমার বউ আমাকে কত বিশ্বাস করে, জানে তার স্বামী ফেরেশতা। আসলে কি জানে তার স্বামী কি? কি তার পরিচয়?
জীবন বড়ই রহস্যময়! যাক আমি আমার কাজ করি। দুলাল নিজের কাজে মন দেয়। সে কোর্টের উকিলের সঙ্গে কথা বলে,
ভাই এইসব মামলা মোকদ্দমা আর কতকাল চালাইতে হবে! মৃত্যুর আগেও মনে হয় এর থেকে নিস্তার পাবো না। ভাই
আমার বাঁচনের কোন ইচ্ছা নাই, ফাঁসি যদি হয় হয়ে যাক। উকিল সান্ত্বনা দেয়, না ভাই আপনার মতো ভাল মানুষের
ফাঁসি হইব না। আমি যতদূর করার করব। সবচেয়ে বড় কথা কি ভাই আপনার পক্ষে তো কোন সাক্ষী প্রমান নাই। দুলাল
মিয়া অধৈর্য হয়ে বলে, না থাকে না থাক, মামলার রায় যা আসে তাই হোক।
উকিল সাহেব আবিরের দিকে তাকিয়ে বলে, ভাই আপনি সব কাজ বাদ দিয়ে মামলাটার পিছে একটু সময় দেন। আর চরম
দুর্দশার দিনে যেই রফিক ছিল তাকে দেখেন কি করে পাওয়া যায়। সেটা তো আমার কাজ না ভাই, পুলিশ তাকে খুঁজে

বাইর করুক। ভাই কিছু কাজ নিজেরও করতে হয়। আপনার বাবা আতিক আহমেদ যেভাবে বলে সেভাবে চললে আপনার
ক্ষতি কি? যে বাবার কারণে আমার মা আত্মহত্যা করেছে সেই বাবার কথা শুনবো আমি! এতে যদি আমার হাজার বার
ফাঁসি হয় তাও আমি তার কথা শুনবো না। যাক আপনার অভিমানের পাল্লা বড়ই ভারী।  বাবার প্রতি আবিরের
বিতৃষ্ণার উক্তি, যে বাবা তার শান সৌকত প্রীতি ছিল তার মহুয়া। স্ত্রী সন্তান তারা কি চাইল সেটার প্রতি তার কোন লক্ষ্য
ছিল না। বাবা উপর আমার বিতৃষ্ণা নিয়ে কথা বলতে চাই না। উকিল সাহেব আমি যে মিথ্যা খুনের আসামি এটার জন্য
আমার কোন আফসোস নেই। তবে কি জানেন আমার বাবার সন্তান থাকতেও সন্তানের মুখ থেকে বাবা ডাক শুনতে পাচ্ছে
না। সন্তানকে কাছে পাচ্ছে না। সন্তানকে দিয়ে তার বিষয় সম্পত্তি ভোগ করাতে পারছে না। এটা যখন ভাবি তখন মনে
বড়ই শান্তি পাই। উকিল রবিউল হাত দিয়ে কপাল চুলকাতে চুলকাতে বলে, আপনাদের বাবা ছেলেকে একসঙ্গে করাতে
পারলে হয়তো এই সমস্যার সমাধান হতো। আমি এই বাবার মুখোমুখি হতে কখনোই চাই না। ঠিক আছে আজকে আমি
উঠি আবার তারিখ মতো হাজির হব।
ঠিক আছে।
আবিরের নিজের ছোট্ট পরিসরে একটা এতিমখানা আছে। ‌সেখানে প্রতি মাসে যে খরচ হয় সে বহন করে। সব বাচ্চাদের
সঙ্গে দেখা করে। দেখা করলে আবির মনে খুব শান্তি পায়। বাচ্চারাও আবিরকে দেখে খুশি হয়।
দুলাল গঞ্জ থেকে দুদিন পর বাড়ি ফেরে। সালেহা স্বামীকে দেখেই বলে, ওই যে আইছে। কোন দেশে যায় কোন দেশে থাকে
আসে আল্লাহই জানেন। ‌দুলাল বউকে বলে, এমন করছ কেন? যেখানেই যাই ফিরে তো আসছি। গঞ্জে যাই মাল আনতে
সেই জায়গা দুইদিন থাকন লাগে মালের জন্য। সালেহার কথা, মাল শুধু তুমিই আনো আর কোন লোকে মাল আনে না।
তুমি তো বরাবর দেখছো মাল আনতে আমার দুদিন লাগে। এটা নিয়ে প্রতিবারই তুমি কথা বলো। আমি চাই এটা নিয়ে
তুমি আর বাড়াবাড়ি করোনা। দুলাল গঞ্জে থেকে ফেরার সময় ছেলে আর বউকে খুশি করার জন্য কিছু আনে না। এইবার
বউয়ের জন্য একটা শাড়ি ছেলের জন্য একটা শার্ট নিয়ে এসেছে। নাও তোমার জন্য একটা শাড়ি এনেছি, বাবা টুটুল কাছে
আসো, ছেলেকে শার্ট বের করে দেয়। শার্ট পেয়ে টুটুল বেজায় খুশি। বাবা তুমি গঞ্জে গেলে আবার আমার জন্য শার্ট
আনবা? হ্যাঁ বাবা আনব।
সালেহা হঠাৎ লক্ষ্য করে উঠানের শার্ট, প্যান্ট, জুতো পরা এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছে। ভদ্রলোক সালেহাকে জিজ্ঞেস করে,
এটা কি আবিরের বাড়ি? সালেহা মাথা নেড়ে না বলে। লোকটি বলে, না আমি যতদূর জানি এখানেই আবির থাকে।
সালেহা অস্পষ্ট স্বরে বলে, এখানে আমি আর আমার স্বামী, সন্তান থাকি, অন্য কেউ থাকেনা। উনি আবার বলে, এখানে
আবির থাকে। আপনি ভুল করছেন এখানে আবির নামে কেউ থাকেনা। এরই মাঝে দুলাল এসে হাজির। দুলাল এবং
লোকটি একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত। আগন্তুক বলে, বাবা আবির তোর খোঁজে পেয়ে আমি এসেছি।
দুলাল বলে, কে আপনার আবির এখানে আবির নামে কেউ থাকে না। আমি হচ্ছি দুলাল, আপনি খোঁজ নিয়ে দেখতে
পারেন। বাবা আর বাবাকে পর করিস না। এই বুড়া বাপকে ক্ষমা করে আমার সঙ্গে চল। সালেহা বলে, আপনি সেই যখন
থেকে যাকে আবির, আবির বলছেন সে তো আবির না, সে হচ্ছে আমার স্বামী দুলালমিয়া। তোমার দুলালেই হচ্ছে আমার
ছেলে আবির। বাবা গাড়ি তোর বাড়িতে নিয়ে আসা যায় না তাই আমি বড় রাস্তায় গাড়ি রেখে এখানে হেঁটে এসেছি। যে
মানুষ আমি এক কদমও পায়ে হাঁটি না, কারো কাছে মাথা নত করি না। আজ তুই আমার ছেলে, তোর কাছে আমি মাথা
নত করছি তুই আমার সঙ্গে চল।
ক্ষুব্ধ কন্ঠে আবির বলে, যে বাড়িতে আমার মা আত্মহত্যা করেছে সেই বাড়িতে ফিরে যাব আমি! আর আপনারই কারণে
খুন না করেও আমি আজ খুনের আসামি। আর আমার আবুলের খুনের রায়ে হতে পারে ফাঁসি। আতিক আহমেদ বলে ওঠে,
না বাবা তুই খুন করিস নি, আমি তোর নামে মিথ্যা মামলা দিয়েছি তোকে আমার কাছে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। আবুল
জীবিত আছে, সে আমারই আওতাতেই আছে। দুলাল বলে, ছেলের সঙ্গে এত বড় জালিয়াতি করতে আপনার বাধলো না?
যা করেছি বাবা তোকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য করেছি? তুই এখন চল।
আপনার সঙ্গে যদি যেতেই হয় আমি এমন জায়গায় যাব যেখান থেকে আর ফিরিয়ে আনতে পারবেন না আমাকে। আতিক
আহমেদ আতঙ্কিত হয়। ছেলে যদি তার মায়ের মতো কিছু করে বসে।  আর কথা না বাড়িয়ে সে ছেলেকে বলে, ঠিক আছে

বাবা তোর যেতে হবে না, তোর নামে মিথ্যা মামলা আমি তুলে নেব।‌ আতিক আহমেদ ফিরে যায়। সালেহা বলে, তাহলে
এই তোমার পরিচয়? কেন তুমি আমাকে এসব বলোনি?
বলিনি এজন্য আমার যেরকম কলঙ্কিত পরিচয় এই পরিচয় জানতে চাইনি। আমি আজও সন্ধিহান আমার মা আত্মহত্যা
করেছে না খুন হয়েছে। কিন্তু আমার বাবা নিজের ছেলের নামে মামলা দিয়ে, নিজে দিব্যি ভালো মানুষ সেজে বসে আছে।
আমার বাবার অনেক কিছু আছে কিন্তু তার মধ্যে কোন সুখ নেই। এই যে তুমি আমার কাছ থেকে চেয়ে নাও তার মধ্যে
একটা শান্তি আছে। কারণ তুমি সেই জিনিসটা নিঃসংকচিত্তে ব্যবহার করতে পারো। যার অনেক থাকে সে সেই জিনিসটা
পরিপূর্ণভাবে ভোগ করতে পারে না। অল্প থাকার মধ্যে ভোগের আনন্দ আছে। প্রাচুর্য মানুষকে সুখী করতে পারে না।

Comments are closed.

     এই ক্যাটাগরিতে আরো সংবাদ